শিরোনাম

বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী এর জীবন কাহিনী

আবু আলি ইবনে সিনা

( খ্রিস্টাব্দঃ৯৮০-১০৩৭)




জ্ঞান- বিজ্ঞানের ইতিহাসে যে জন মুসলিম বিজ্ঞানী  পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তার মধ্যে আবু-ইবন সিনা অন্যতম তাঁর পুরো নাম আবু আলি হোসেন ইবন আবদাল্লা হাসান আলি সিনা সংক্ষেপে বলা হয় ইবন সিনা বা আবিসেনা আবু-ইবন সিনা মধ্যযুগের এক বড় বিস্ময় তিনি ছিলেন মূলত চিকিৎসা বিজ্ঞানী
ইবন সিনা চিকিৎসাবিজ্ঞানীর হিসেবেই জগৎজোড়া সুনাম অর্জন করেছিলেন তাঁর লেখা চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ  “আল কানন ফি খাল টিব্বকে দীর্ঘকাল কাল  ইউরোপ চিকিৎসার ক্ষেত্রে একমাত্র নির্রযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে এসেছিল মানবদেহের অঙ্গ সংস্থান শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে ইবন সিনা যেসব তথ্য প্রদান করেছিলেন সেগুলি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশের চিকিৎসকেরা অনুকরণ করে এসেছিলেন পরে অবশ্য ইবন সিনা প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে কিছু কিছু ক্রটি ধরা পড়ে এবং  পরিত্যক্ত হয় তবে সমূহ তথ্য যে পরিত্যক্ত এমন নয় শল্য চিকিংসার ক্ষেত্রে আছে ইবন সিনার কালজয়ী অবদান কাঁধের সন্ধিচ্যুতিকে সোজার করার একটি পদ্ধতি আজও তার নামকে বহন করে চলেছে
আনুমানিক ৯৮০ খ্রীষ্টব্দের সেপ্টেম্বরে তিনি বোখারার আফসেনা শহরে এক সরকারি কর্মচারীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন স্থানটি বর্তমানে উজবেকিস্থানের অন্তর্তগত পিতার নাম আবদাল্লা এবং মা সিতারা
ছেলেবেলা থেকে ইবন সিনা ছিলেন অত্যন্ত বেধাবী শোনা য়ায়, মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআন কন্ঠস্থ করে ফেলেছিলেন এবং অল্প কিছুকালের মধ্যে সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, ইউক্লিডের জ্যামিজিতি, অ্যারিষ্টটলের দর্শন জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ভারতীয় বীজগণিতে  ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন পিতার ইচ্ছায় তাঁকে আইনশাস্ত্রও অধ্যয়ন করতে হয়েছিল তথ্যপি গণিত চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে আকর্ষণ ছিল ছেলেবেলা থেকেই পড়তে শুরু করেন এবং যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন কথিত আছে, দর্শনশাস্ত্রও অধ্যয়ন করেছিলেন তিনি


কিছুকাল পরে তাঁর জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে বখারার সুলতান সেই সময় এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দেশ-বিদেশ থেকে বহু নামকরা চিকিৎসক আসেন তাঁকে চিকিৎসা করতে কিন্তু কেউ তাঁর রোগ নির্ণয় করতে পারলেন না তখন তরুণ ইবনে সেনা স্বেচ্ছায় রাজ দরবারে গিয়ে রাজার চিকিৎসার জন্য প্রার্থনা জানালেন অনমতি লাভ করতে বিলম্ব হল না ইবন সিনার চিচিৎসার গুণে অতি অল্পদিনের মধ্যে আরোগ্যলাভ করলেন সুলতান সুলতান খুশি হয়ে পুরস্কৃত করতে চাইলে ইবন সিনা সুলতানের প্রিয় এক বিরাট গ্রন্থাগারে এসে পড়াশোনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে আরও খুশি হলেন এবং ইবন নিনার উপরেই গ্রন্থাগারের ভার অর্পণ করলেনকিছুকাল পরে গ্রন্থাগরে আগুন লাগে এবং সমস্থ বই পুড়ে নষ্ট হয়ে যায় বিরোধীরা রটালেন, এটি ইবন সিনারই কাজ তিনি বইগুলো কন্ঠস্থ করে নিয়ে ইচ্ছে করেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন কানপাতলা সুলতান বিরোধীদের কথায় বিশ্বাস করলেন এবং ইবন সিনাকে তাড়িয়ে দিলেন
সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল তবুও খলিফাদের সময় থেকে অতি ক্ষুদ্র এক রাজ্যের রাজা পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহশীল হয়ে উঠেছিলেন প্রত্যেকেই চাইতেন, রাজসভায় বড়বড় পন্ডিতদের নিয়োগ করতেতাই ইবন নিনার অসুবিধা হল না বখারা পরিত্যাগ করে খরজেম গেলে সেখানকার সুলতান তাঁকে রাজচিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ করলেন খরজেমের রাজসভায় আরও বহু পন্ডিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসদ, বিজ্ঞানী দার্শনিক আলবেরুণী (যিনি সুলতান মামুদের সঙ্গে ভারতবর্ষে এসেছিলেন এবং তৎকালীন ভারতের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন) ইবন সিনা,আলবেরুনী প্রভৃতি পন্ডিতের পান্ডিত্যের খ্যাতি একদিন সুলতান মামুদের কর্ণগোচর হলে খরজেমের সুলতানের কাছে দাবী করলেন পন্ডিতদের তাঁরই সভায় প্রেরণ করার জন্য
মামুদের দাবীকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা খরজেম শাসকের ছিল না আলবেরুনী, ইবন সিনা সহ সমস্ত পন্ডিতকে পাঠিয়ে দিলেন মামুদের কাছে কিন্তু ইবন সিনা মামুদের দাবী মানতে পারলেন না মামুদের রাজসভায় যোগদান করতে কেমন যেন ঘৃণা বোধ করলেন তিনি তািই পথে সুকৌশলে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে পালিয়ে গেলেন
পথে পথে কিছুদিন ঘোরাপোরা করার পর একদিন উপস্থিত হলেন ইরানের রাজসভায় সুলতান তাঁর পরিচয় পেয়ে খুব আনন্দিত হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই দান করলেন সভাপন্ডিতের পদ কিন্তু সুলতান মামুদ এত সহজে হার মানার পাত্র ছিলেন না যথাসময়ে চরের মুখে সংবাদ পেলেন ইবনে সিনা ইরানের রাজপন্ডিতের পদ অলঙ্কৃত করেছেন আর তখনই গুপ্তচরদের নির্দেশ দিলেন ইবন সিনাকে বেঁধে আনার জন্য
ইবন সিনা কিন্তু আগেভাগে টের পেয়ে গেলেন এবং গোপনে পালিয়ে গেলেনহামাদানেসেখানে লাভ করলেন প্রধান উজিরের পদ
হামাদানে বেশ কিছুকাল সুখে ছিলেন তিনি কিন্তু সে সুখ তার স্থায়ী হল না এক বিদেশীর আধিপত্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন রাজপুরুষেরা এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন তখই বিরক্ত হয়ে তিনি উজিরের পদ পরিত্যাগ করে চলে গেলেন ইস্পাহানে জীবনের আবশিষ্ট দিনগুলি তিনি এই ইস্পাহানে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি তিনি এই ইস্পাহানেই কাটিয়েছেন এবং তাঁর মূল্যবান গ্রন্থগুলিও রচনা করেছেন এখানে
ইবন সিনার মত এতবড় চিকিৎসাবিজ্ঞানী সে যুগে কেউ ছিলেন না কেবল তাই নয়, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা গণিতে তাঁর মত পন্ডিত গ্রীক ভারতীয় বিজ্ঞানের অবনতির পর থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত দ্বিতীয় কেউ আবির্ভুত হননি বলা চলে তাছাড়া সমসাময়িক কালে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রাজনীতিজ্ঞ ইবন সিনা তাঁর যুগের একজন বড় কবিও ছিলেন তাঁর লেখা বহু কবিতা পাওয়া গেছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় একজন মানুষ স্বৈরাচারী দাম্ভিক রাষ্ট্রনায়কদের তিনি মনে মনে ভীষণ ঘৃণা করতেন যুদ্ধকে তিনি কোনদিনও বরদ্স্থ করতে পারেননি যদিও রাজনীতির ঘুর্ণবর্তে পড়ে তাঁকে বার বার যুদ্ধেকে তিনি সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্র এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে রাষ্ট্রের জনগণকে রক্ষা করাই শাসকের একমাত্র কর্তব্য হওয়া উচিত তিনি আরও মনে করতেন, শাসক ন্যায়বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হলেই দেশের  সর্বাঙ্গীন উন্নতি সম্ভব
ইবন সিনা ছিলেন অবিবাহিত তিনি তাঁর কাজের অসুবিধা হবে এই ভয়ে কখনও বিয়ে করেন নি যদিও বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত রমণী তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন এমনকি কয়েকজন রাজকুমারীও তাঁর সহধর্মিনী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু কখনো সেসব বিষয়ে কর্ণপাত করেননি জীবনের অনেক চড়ৎ-উৎড়াই পেরোতে গিয়ে, ঝঞ্বা-বিক্ষুব্দ জীবনের আবর্তে তিনি নিজের প্রতি ছিলেন খুবই উদাসীন তাই একসময় তাঁর শরীরে পিত্তশূলের উপস্থিতিতি দেখা দিল অবশেষে ১০৩৭ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করছেন১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দে পূর্ণ হয়েছে তাঁর জন্ম সহস্র বার্ষিকী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে এই বছরটি পালন করেছে তাঁর লেখা বহু পুস্তক বছর পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনবাদ করা হয়েছে
হাজার বছর আগে ইবন সিনা এই পৃতিবীর আলো বাতাসে বসে যে জ্ঞান চর্চা করেগেছেন আমরা আজও তার সুফল ভোগ করিছ তিনি পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর জ্ঞান সাধনার নির্যাসটুকু এখনও গ্রহণ করছি আমরা তাই তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে

প্রকাষনায়
মোঃ হুমাযুন কবীর চৌধুরী
চৌধুরী এন্ড সন্স

৪৮, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০

No comments